ঢাকা শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪ 

চন্দ্রাবতী- বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবি

নাসরীন গীতি

প্রকাশিত: ১৮:৩৪, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

শেয়ার

চন্দ্রাবতী- বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবি
কবি চন্দ্রাবতীর মন্দির

বাংলা ভাষার আদি নারী কবি বলতে সবাই এক বাক্যে আজও খনা, রামী, মাধবী ও চন্দ্রাবতীর নামই বলবেন। কিন্তু বাংলাদেশ বা পূর্ববাংলার প্রথম নারী কবি কে? সাহিত্যাঙ্গনে এ প্রশ্নেরও একবাক্যেই উত্তর আসবে, বাংলাদেশের প্রথম নারী কবি হলেন কিশোরগঞ্জের চন্দ্রাবতী। অনেকের ধারণা, বাংলা সাহিত্যেরই প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতী। যদিও তথ্যসূত্র তা বলে না। বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবি খনা, দ্বিতীয় নারী কবি রামী বা রামী রজকিনী, বিখ্যাত কবি চণ্ডীদাস যার প্রেমে উতলা হয়ে জগৎ-সংসার ভুলে গিয়েছিলেন, তৃতীয় কবি মাধবী এবং চতুর্থ কবি চন্দ্রাবতী। 

যাইহোক, বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবি হিসেবে আমরা আজ চন্দ্রাবতীর কথাই তুলে ধরছি। সপ্তদশ শতাব্দীর মহিলা কবি চন্দ্রাবতী। তিনি ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বঙ্গদেশের ময়মনসিংহের পাতুয়ারি গ্রামে (বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জে) জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বাবা মনষামঙ্গল কাব্যের অন্যতম রচয়িতা বংশীদাস ভট্টাচার্য এবং মা সুলোচনা (অঞ্জনা)। 
ষোড়শ শতাব্দী বা তার আগে চন্দ্রাবতীর মতো উঁচু মাপের নারী কবির অস্তিত্ব ছিল না। তাঁর সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় সুকুমার সেনের লেখায়। সুকুমার সেন তার বাঙ্গালা সাহিত্যের কথায় লিখেছেন: ‘পূর্ববঙ্গে রচিত বিস্তর মনসামঙ্গল কাব্য পাওয়া গিয়াছে। সে সবগুলির মধ্যে বংশীবদনের কাব্যই শ্রেষ্ঠ। সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত হইয়াও বংশীবদন কোথাও অযথা পাণ্ডিত্য প্রদর্শন করিতে চেষ্টা করেন নাই। অপরদিকে, ইহার কাব্য গ্রাম্যতা দোষ হইতে একেবারে মুক্ত।’ উত্তরাধিকারসূত্রে পিতার কবিত্ব শক্তি লাভ করেছিলেন চন্দ্রাবতী।
দ্বিজ বংশীদাসের মনসার ভাসান গান চন্দ্রাবতীকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় এক স্বপ্নের কল্পনা-সাগরে। পিতার সঙ্গে চন্দ্রাবতী রচনা করেন মনসার ভাসান গান। ফুলেশ্বরী নদীর তীরে চোখ-জুড়ানো, শান্ত নিরিবিলি নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর বিল-ঝিল, নদীনালা, পুকুর-দিঘি আর প্রকাণ্ড বৃক্ষের শ্যামল ছায়ার সবুজ শান্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠেন চন্দ্রাবতী। প্রেম বিরহগাঁথা, বৈষম্য, অবিচার চন্দ্রাবতীর গীতিকা-সাহিত্যের অন্যতম অনুষঙ্গ। সাড়ে চারশ বছর আগে রচিত তার পালাগান আজো বিভিন্ন আসরে শোনা যায়।
চন্দ্রাবতীর জীবনের ইতিহাসটি বড় করুণ। বাল্যকালে চন্দ্রাবতীর বন্ধু ও খেলার সাথী ছিলেন জয়ানন্দ নামে এক অনাথ বালক। জয়ানন্দের বাড়ি সুন্ধা গ্রামে। জয়ানন্দ তার মাতুলগৃহে পালিত। দ্বিজ বংশীদাসের অনেক রচনায় চন্দ্রাবতী ও জয়ানন্দ, দু’জনেরই রচিত ছোট ছোট অনেক পদ রয়েছে।
 
চন্দ্রাবতীর রচিত কাব্যগুলি হলো:

মলুয়া, 
দস্যু কেনারামের পালা (মনসার ভাসান, রচনাকাল: ১৫৭৫ শকাব্দ),
রামায়ণ

চন্দ্রাবতী বাল্যকাল থেকেই বাবার দেখাদেখি কবিতা লেখা শুরু করেন। গানও লিখতেন। শুধু লিখতেনই না, নিজেও গাইতেন। এত সব গুণের কারণে সম্ভ্রান্ত পরিবারের বহু ব্যক্তি চন্দ্রাবতীকে বিয়ে করার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু চন্দ্রাবতী সেই ছেলেবেলাতেই মন দিয়ে বসে আছেন জয়ানন্দকে। বেড়ে ওঠার সাথে সাথে প্রেমের বন্ধনে বাঁধা পড়েছেন দু’জনে। কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ ঘটে তাদের পারস্পরিক অনুভব। দু’জন দু’জনকে কবিতা লিখে ভালোবাসা জানাতেন। আর এভাবেই এক সময় দ্বিজ বংশীদাসের নিজস্ব বিষয়ের বাইরেও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কবিতা রচনা শুরু করেন তারা। কবি দ্বিজ বংশীর পদ্মপুরাণে চন্দ্রাবতী এবং জয়ানন্দ, দু’জনেরই কবিতা রয়েছে। কৈশোর উত্তীর্ণ হলে দু’জনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন বলে স্থির করেন; শুধু তারা দু’জনে নন, পরিবারবর্গও রাজী।
জয়ানন্দকে ভালোবেসে তার কাছে হৃদয় সঁপে দিয়ে পরম নিশ্চিন্তে ছিলেন চন্দ্রাবতী। তিনি নিজের মতো করেই জয়ানন্দকে বিশ্বাস করতেন।  অন্যদিকে, জয়ানন্দ যত-ই ভালোবাসুক চন্দ্রাবতীকে, একসঙ্গে বসে যতই কবিতা বা ছড়া বাঁধুক, দ্বিজ বংশীদাসকে তার মঙ্গল কাব্য রচনায় চন্দ্রাবতীর মতো যত-ই প্রেরণা যোগাক ছোটখাটো পঙ্‌ক্তি দিয়ে সাহায্য করুক, তার হৃদয়, চোখ, কান সর্বদাই ধেয়ে বেড়াতো অন্য দিকে, তার চারপাশে। ফলে এক সময় গ্রামের আরেক সুন্দরী আসমানীকে চোখে ধরে জয়ানন্দের। পত্রমিতালী করে তার সঙ্গে। গান বাঁধে তার রূপের বর্ণনা করে।
আসমানী (ডাক নাম কমলা) ছিলেন স্থানীয় মুসলমান সমাজনেতা বা কাজীর মেয়ে। আসমানীর অসামান্য রূপে মুগ্ধ হয়ে জয়ানন্দ তাকে একাধিক প্রেমপত্র লেখেন। এক সময় এই ত্রিকোণ প্রেমের ফলাফল হয়ে ওঠে মারাত্মক। জয়ানন্দের সাথে চন্দ্রাবতীর প্রেমের কথা ও প্রস্তাবিত বিবাহের কথা জানা সত্ত্বেও, আসমানী তার পিতাকে জানান তিনি জয়ানন্দকেই বিবাহ করতে চান। এক সূত্র অনুযায়ী, কাজী জয়ানন্দকে বলপূর্বক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করে আসমানীর সঙ্গে তার বিবাহ দেন। ভিন্ন মত অনুযায়ী, জয়ানন্দ নিজের ইচ্ছেতেই আসমানীর রূপে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিয়ে তাকে বিয়ে করেন, এবং সেটা করেন সেই সন্ধ্যাতেই যে সন্ধ্যায় তার বিয়ের কথা ছিল চন্দ্রাবতীর সঙ্গে, যখন বধূসাজে চন্দ্রাবতী তার আগমনের অপেক্ষায় ছিলেন। আর তখনই সংবাদ পান চন্দ্রাবতী, জয়ানন্দ ধর্মান্তরিত হয়ে অন্যত্র বিবাহ করেছেন। 
এরপর শুরু হয় চন্দ্রাবতীর বিরহবিধুর জীবন। তিনি পিতা দ্বিজ বংশীদাসের কাছে দু’টি প্রার্থনা করেন: এক ফুলেশ্বরী নদীর তীরে তার আরাধনার জন্যে একটি শিব মন্দির স্থাপন করা হোক। অন্যটি, তার চিরকুমারী থাকার বাসনা। তিনি পিতার কাছে অনুমতি নেন যে সারা জীবন অবিবাহিতা থেকে শিবের সাধনা করবেন। পিতা তার আদরের কন্যার দু’টি ইচ্ছাই পূর্ণ করেন। 

চন্দ্রাবতী বলে ‘পিতা সম বাক্য ধর।
জন্মে না করিব বিয়া রইব আইবর॥
শিবপূজা করি আমি শিবপদে মতি।
দুঃখিনীর কথা রাখ কর অনুমতি’॥
অনুমতি দিয়া পিতা কয় কন্যার স্থানে।
‘শিবপূজা কর আর লেখ রামায়ণে’॥ 

বেশ কিছুদিন এভাবেই কাটে। এক পর্যায়ে জয়ানন্দ বুঝতে পারেন যে, আসমানীর প্রতি তার ভালবাসা নয়, ছিল মোহ। আসমানীর অসামান্য রূপেই কেবল আকর্ষিত হয়েছিলেন জয়ানন্দ। মনের থেকে তিনি চন্দ্রাবতীকেই প্রকৃত ভালোবাসেন। জয়ানন্দ চন্দ্রাবতীর সঙ্গে কবিতা রচনার অভিজ্ঞতা ও গাছের ছায়ায় বসে কাব্যপাঠের আনন্দ ফিরে পেতে অস্থির হয়ে ওঠেন। এক সন্ধ্যায় জয়ানন্দ হাজির হলেন পাটোয়ারী গ্রামে। দিন ও রাত্রির সন্ধিক্ষণ তখন। শিব মন্দিরের ভেতর দরজা বন্ধ করে আরাধনায় নিমগ্ন ছিলেন চন্দ্রাবতী। জয়ানন্দ মন্দিরের দ্বারে এসে কয়েকবার ডাকলেন। কিন্তু দরজা বন্ধ থাকায় এবং একাগ্রমনে ধ্যানে নিমগ্ন থাকায় সেই শব্দ প্রবেশ করল না চন্দ্রাবতীর কানে। ব্যর্থ প্রেমিক জয়ানন্দ তখন মন্দিরের প্রধান দরজায় ছোট্ট একটি কবিতা লিখে চন্দ্রাবতীর কাছে আকুতি জানান তাদের আবাল্যকালীন প্রেমের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে ক্ষমা করে পুনরায় গ্রহণ করার জন্যে-

‘শৈশব কালের সঙ্গি তুমি যৌবনকালের সাথী।
অপরাধ ক্ষমা কর তুমি চন্দ্রাবতী’॥

কিন্তু অভিমানে, অপমানে জর্জরিত চন্দ্রাবতী মুখ ফিরিয়েও দেখেন না প্রাক্তনকে। সারা না পেয়ে জয়ানন্দ এই পরিচিত জগতকে চিরবিদায় জানিয়ে, মন্দিরের পার্শ্ববর্তী ফুলেশ্বরী নদীতে ডুবে আত্মহত্যা করেন। 
আরেক ভাষ্য মতে, চন্দ্রাবতীকে এক নজর দেখার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন জয়ানন্দ। পিতার অনুমতি না থাকায় চন্দ্রাবতী জয়ানন্দকে সাক্ষাৎ দিতে পারেননি। 
দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে ক্লান্ত জয়ানন্দের প্রস্থানের অনেক পরে মন্দির থেকে বেরিয়ে চন্দ্রাবতী কলসী কাঁখে জল আনতে যান ফুলেশ্বরী (স্থানীয় নাম ফুলিয়া) নদীতে। ঘাটে পৌঁছেই চন্দ্রাবতী বুঝলেন সব শেষ। ফুলেশ্বরীর জলে নিজেকে সঁপে দিয়ে প্রাণত্যাগ করেছেন জয়ানন্দ। তার প্রাণহীন দেহ ভাসছে ফুলেশ্বরীর জলে। এই অবস্থায় নিজের আবেগ, নিজের অন্তহীন বেদনা ধরে রাখতে পারলেন না চন্দ্রাবতী। তিনিও প্রেমিকের সাথে পরলোকে চিরমিলনের আশায় ফুলেশ্বরীর জলে ডুবে প্রাণত্যাগ করেন। অবশ্য অন্যরা বলেন, জয়ানন্দ মারা যাবার পরেও বেশ কিছুদিন বেঁচেছিলেন চন্দ্রাবতী এবং তার স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছিল পঞ্চাশ বছর বয়সে। আবার কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বংশীদাস-কন্যা চন্দ্রাবতী।
চন্দ্রাবতীর মৃত্যু নিয়েও সবাই একমত নন, নয়ানচাঁদ নিজেও চন্দ্রাবতী পালাগানে চন্দ্রাবতীর মৃত্যু নিয়ে কিছু বলেন নি। কারো কারো মতে, নদীর ঘাটে জলে মৃত অবস্থায় জয়ানন্দের লাশ ভাসতে দেখে তীব্র অনুশোচনায় চন্দ্রাবতীও ফুলেশ্বরী নদীর জলে ঝাঁপিয়ে জয়ানন্দের অনুগামী হন, তবে সঙ্গে সঙ্গে নয়, কিছু পরে। আবার কারো মতে, জয়ানন্দের জলে ডুবে আত্মহত্যার কিছুদিন পরপরই মর্মান্তিক আঘাত প্রাপ্ত শোকাবিভূত চন্দ্রাবতী স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন। দীনেশচন্দ্র সেন মৈমনসিংহ-গীতিকার ভূমিকায় লিখেছেন: ‘প্রবাদ এই যে, প্রেমাহতা চন্দ্রা জয়চন্দ্রের শিব দর্শন করার অল্পকাল পরেই হৃদরোগে লীলা সংবরণ করেন।’
কবি চন্দ্রাবতীর জীবনী অবলম্বনে পরবর্তী সময়কার কবি নয়ানচাঁদ ঘোষ রচিত 'চন্দ্রাবতী' পালায় তার কথা পাওয়া যায়। তাঁর জীবনের ট্র্যাজেডি নিয়ে রচিত লোকগাঁথা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অবিভক্ত ময়মনসিংহ জেলার মানুষের মুখে মুখে ফিরে এসেছে। 
পল্লী সাহিত্যের সংগ্রাহক ড. দীনেশচন্দ্র সেন ১৯৩২ সালে চন্দ্রাবতীর রামায়ণ প্রকাশ করেন। লৌকিক মানবিক ও কিছু মৌলিক উপাদান সংযোগের ফলে এই রামায়ণ কাব্যটি বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে। দীনেশচন্দ্রের মতে, মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার মেঘনাদবধ কাব্যের সীতা-রামের কথোপকথনের অংশটি 'চন্দ্রাবতীর রামায়ণ' থেকে গ্রহণ করেছিলেন।
চন্দ্রাবতীর রচিত বিভিন্ন গীতিকবিতার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় লোকগাঁথা হলো মলুয়া। পালাগানের বন্দনাটির একাংশ এরকম:
জল বন্দুম স্থল বন্দুম আকাশ পাতাল।
হর শিরে বন্দিয়া গাই কাল মহাকাল ॥
তারপরে বন্দিলাম শ্রীগুরু চরণ।
সবার চরণ বন্দিয়া জানাই নিবেদন ॥
চার কুণা পৃথিবী বন্দিয়া করিলাম ইতি।
সলাভ্য বন্দনা গীতি গায় চন্দ্রাবতী ॥

লক্ষণীয়, তখনো চন্দ্রাবতীর মতো শিক্ষিত, রুচিশীলা নারী যিনি নিজে কাব্য রচনা করেন, পৃথিবীকে গোলাকার না বলে প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী ‘চার কুণা’ বলে অভিহিত করেছেন। 
মলুয়ার পালার ‘জলপ্লাবন ও দুর্ভিক্ষ’ অধ্যায়ে তৎকালীন পল্লী-জীবনের দুর্দশা ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে। কৃষিনির্ভর গ্রামীণ জীবন পরিপূর্ণভাবে প্রকৃতির খেয়ালখুশি মতো পরিচালিত হতো তখন। সংক্রামক ব্যাধি, বন্যা, ফসল বিনাশ, দুর্ভিক্ষ, মানুষের উপায়হীনতা জীবনের অবধারিত অংশ হয়ে গিয়েছিল। মলুয়া পালায় বন্যা ও দুর্ভিক্ষ কেমন করে পল্লী-জীবনের সকল আশাভরসা বিনাশ করে দুঃখে আর কষ্টে নিমজ্জিত করে দিত ব্যক্তি জীবন, তার মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিয়েছেন চন্দ্রাবতী।
দস্যু কেনারামের পালাতেও ‘কেনারামের জন্ম ও নানা কষ্ট’ পরিচ্ছেদে ফুটে উঠেছে মানবিক দুর্ভোগের যাতনা। কবিতার প্রতিটি ছত্রে ছত্রে এই সীমাহীন দারিদ্র্য ও কষ্টের ছবি প্রতিফলিত। গ্রামে মাতৃত্বজনিত কারণে অবেলায় মায়ের মৃত্যু, বন্ধ্যাত্বের জ্বালা ইত্যাদি পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে এই কাব্যে।
তার লেখা ‘রামায়ণ কথা’ একটি এমন রচনা যেখানে রামের গুণগানের বদলে সীতার দুঃখ দুর্দশাই তিনি বর্ণনা করেছেন। একজন নারীর দৃষ্টিতে এই মহাকাব্য রচনা স্বাভাবিকভাবেই পণ্ডিত সমাজে অবাঞ্ছিত বলেই তাকে দুর্বল ও অসমাপ্ত সাহিত্য আখ্যা দিয়ে গুরুত্বহীন করে রাখা হয়েছিল। 
চন্দ্রাবতীর গান ময়মনসিংহে সুপরিচিত। চন্দ্রকুমার দে বলেছেন, ‘শ্রাবণের মেঘভরা আকাশতলে ভরা নদীতে যখন পাইকগণ সাঁজের নৌকা সারি দিয়া বাহিয়া যায়, তখন শুনি সেই চন্দ্রাবতীর গান, বিবাহে কুলকামিনীগণ নব বর-বধূকে স্নান করাইতে জলভরণে যাইতেছে, সেই চন্দ্রাবতীর গান, তারপর স্নানের সংগীত, ক্ষৌরকার বরকে কামাইবে তাহার সংগীত, বরবধূর পাশাখেলা, তার সংগীত সে কত রকম!’
চন্দ্রাবতীর লেখা পাশাখেলার একটা সংগীত নিচে দেয়া হলো:

‘কি আনন্দ হইল সইগো রস বৃন্দাবনে,
শ্যামনাগরে খেলায় পাশা মনমোহিনীর সনে।
আজি কি আনন্দ
উপরে চান্দোয়া টাঙ্গান নিচে শীতলপাটি,
তার নিচে খেলায় পাশা জমিদারের বেটি
আজি কি আনন্দ
চন্দ্রাবতী কহে পাশা খেলায় বিনোদিনী
পাশাতে এবার হারিল শ্যামগুণমণি!
আজি কি আনন্দ’

চন্দ্রাবতীর রচনা আজ বিশ্বে আলোচিত। পৃথিবীর একুশটি ভাষায় তার লেখা অনুদিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, কবি চন্দ্রাবতীর রচনা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে পৃথিবীর নানা দেশে। বিদেশী গবেষকবৃন্দ প্রায়ই আসছেন কবির তীর্থভূমি কিশোরগঞ্জে।
জয়ানন্দের গ্রাম সুন্ধা খুঁজে পাওয়া যায় নি। তবে ইতিহাসের স্মৃতিবিজড়িত পাটোয়ারী গ্রাম আজও আছে। কিশোরগঞ্জ শহর থেকে উত্তর পূর্বদিকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে। আর আছে ফুলেশ্বরী নদীর ধারে চন্দ্রাবতীর পূজিত সেই বিখ্যাত শিব মন্দির। প্রায় পাঁচশ বছরের দীর্ঘ ব্যবধানে ফুলেশ্বরী নদী বিলীন হয়ে গেছে, কিন্তু তার পাড়ের শিবমন্দির, আজো দাঁড়িয়ে আছে চন্দ্রাবতীর স্মৃতির সাক্ষ্য হয়ে। 

বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা চন্দ্রাবতী (যাকে বাংলা সাহিত্যের অনেকেই ভুলে গেছেন) ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ৫০ বছর বয়সে মারা যান।

দ্য নিউজ/ এনজি

live pharmacy
umchltd

সম্পর্কিত বিষয়: