ঢাকা শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪ 

রিভিউ

কবি গুরুর ‘শ্যামাপ্রেম’ ও রাষ্ট্রের চরিত্র

মাহী মাহফুজ

প্রকাশিত: ১২:১৭, ৮ মার্চ ২০২৪

আপডেট: ১৯:২৯, ৯ মার্চ ২০২৪

শেয়ার

কবি গুরুর ‘শ্যামাপ্রেম’ ও রাষ্ট্রের চরিত্র

প্রেম সার্বজনীন।

না মানে কোন বাঁধা,

না মানে কোন জাত বা পেশা।

আত্মার সাথে আত্মার মিল হলে, প্রেম পাড়ি দিতে পারে সাতসমুদ্র, জয় করতে পারে এভারেস্টের সর্বোচ্চ চূড়া। ফাঁসির দড়ি মালা বানিয়ে আত্মহুতি দেওয়াতো আছেই। গরীবের ছেলের সাথে বড় লোকের মেয়ে সম্পর্ক, রাজকন্যার সাথে চাকরের সম্পর্ক বা একজন গণিকা/বেশ্যার সাথে সমাজের ভালো মানুষের সম্পর্ক হতেই পারে। কিন্তু এই দু’জনের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সমাজ নামক দুষ্টচক্র। কে বলেছে, গরীব বড়লোকের সাথে প্রেম করতে পারবে না। কোথায় লেখা আছে, একজন গণিকার প্রেম করার অধিকার নাই? কিংবা তার ভালো হওয়ার অধিকার নাই? আছে, কিন্তু সমাজ কি আদৌ সেটা চায়! প্রেম, রাষ্ট্র ও সমাজের এমনই এক দ্বন্দ্ব নিয়ে কবি গুরুর বিখ্যাত নাটক ‘শ্যামাপ্রেম।’


একজন গণিকার মধ্যে প্রেমের জন্য যে হাহাকার থাকতে পারে এবং প্রেমের জন্য সবকিছু বিসর্জন দিতে প্রস্তুত থাকতে পারে, রবীন্দ্রনাথের সৌজন্যে সেটা দেখার সৌভাগ্যে হল। আর সেই গণিকাই হল নাটকের মূল চরিত্র, শ্যামা সুন্দরী। শ্যামা গাঁয়ের খেটে খাওয়া এক দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। ব্রিটিশদের পা চাটা জমিদারদের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে, তার পরিবার ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরে, শ্যামা শহরে এসে পেটের দায়ে গণিকার পেশা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। একপর্যায়ে, গণিকা পেশার বদৌলতে শ্যামা সুন্দরী অঢেল সম্পদের মালিক হয়ে যান। এভাবে চলতে চলতে একদিন উথ্থিও এর সাথে দেখো হয়ে যায় শ্যামার। যার সাথে জীবনের শৈশবের হাসি-খুশিময় সময় কাটিয়েছেন। কখনো বৃষ্টিতে ভিজেছেন, কখনো নদীতে একসাথে সাঁতার কেটেছেন, কখনো বা কাঁনামাছি খেলেছেন একসাথে। হাজারো স্মৃতির রোমাঞ্চে কিছু সময়ের জন্য দু’জনেই ফিরে যায় শৈশবের ফেলে আসা দিনগুলোতে। গ্রামে থাকতেই শ্যামার প্রতি আলাদা একটা টান অনুভব করতো উথ্থিও। পরিণত শ্যামা সুন্দরীকে দেখার পর তার চাপা প্রেমটাও বুঝি পরিণত বোধ করতে লাগলো। কিছুদিন পরপরই সে শ্যামার বাসায় আসতো এবং অনেক সময় ধরে গল্প করে যেতো। এভাবে কিছুদিন চলার পর উথ্থিও বলেই ফেলল, শ্যামা তোকে ছাড়া আমি যে আর কিছুই চিন্তা করতে পারি না। আমি তোকে পেতে চাই, সারাজীবনের জন্য পেতে চাই। নিরবতা..! কেউ কোন কথা বলে না।


শ্যামা সুন্দরীর, সত্যিকার অর্থে কিছুই করার নেই। কিছুদিন পূর্বেই সে একজনকে কথা দিয়েছে যে, তাকে নিয়ে সে ঘর বাধবে এবং গণিকাবৃত্তি ছেড়ে, দুরে কোথাও চলে যাবে। আর যাকে কথা দিয়েছে, সে হলো বিদেশী সওদাগর বজ্রসেন। শ্যামা সুন্দরী পবিত্র সংসারে মনোনিবেশ করবে বলে, গণিকা বৃত্তি একপ্রকার ছেড়েই দিয়েছেন। বজ্রসেনও চায় না, শ্যামা আর গণিকাবৃত্তি করুক। বজ্রসেনের জন্যই শ্যামা সুন্দরী দীর্ঘদিনের পেশা গণিকাবৃত্তি ছেড়ে দিয়েছেন বলা যায়। ভালবাসার জন্য মানুষ সবই পারে, গণিকাবৃত্তিতো কোনো ব্যাপারই নয়, তার কাছে। সম্মান ও মর্যাদা এবং একটু সুখে শান্তিতে জীবনযাপন করার জন্য শ্যামা সুন্দরী ত্যাগ করলেন, বেশ্যাবৃত্তি/গণিকাবৃত্তি। আর সেই গণিকাবৃত্তি ত্যাগই কাল হয়ে দাড়াল শ্যামার শান্তির পথে। পদে পদে শুরু হলো বাধা আর বিপত্তি। তার সাথে আবার উথ্থিও’র নিঃস্বার্থ ভালবাসা। শ্যামার বুঝতে আর বাকি থাকে না, তার জন্য যদি কেউ জীবন দিতে পারে সে হলো উথ্থিও, আর কেউ নয়। এমন কি বজ্রসেনও নয়।


শ্যামা আর কিছুদিনের মধ্যেই বজ্রসেনকে নিয়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যাবে। এর মধ্যে জমিদারের কাছ থেকে ফরমান আসলো যে, শ্যামাকে জমিদার বাড়িতে নাচতে হবে, মানে তাদের মনোরঞ্জন করতে হবে। শরীর খারাপের কথা বলে, তাদের বিদায় করার চেষ্টা করেন কিন্তু তাকে নির্দেশ দেওয়া হয় শরীর ভাল হওয়ার তিনদিন পরই তাকে নাচতে হবে। তিনদিন অতিবাহিত হওয়ার পর শ্যামার অনুপস্থিতি দেখে আবার শ্যামার বাসায় চলে আসেন জমিদারের সেনাপতি। এবারও অনাগ্রহ প্রকাশ করলে, সেনাপতির কাছে বিষয়টি সন্দেহের উদ্রেক করে। পরে অনুসন্ধান করে, তারা জানতে পারে যে, বজ্রসেনের সাথে ঘর বাধার স্বপ্নই শ্যামাকে গণিকাবৃত্তি থেকে বিরত রাখছে। আদেশ অমান্য করাকে স্বাভাবিকভাবে নেয়নি মহামান্য জমিদার। শ্যামার সুখ শান্তি কিভাবে নষ্ট করা যায় এবং বজ্রসেনকে শায়েস্তা করা যায়, সেই দিকে মনোনিবেশ করলেন সমগ্র জমিদারী শাসকবর্গ।


বজ্রসেন ছিলেন একজন বিদেশী সওদাগর। ফলে তাকে ফাঁসানোর কৌশল আঁটতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি জমিদারকে। বজ্রসেনের নামে সমন জারি করা হলো যে, সে একজন বিদেশী গোয়েন্দা। আমাদের রাজ্যের ক্ষতিসাধনের জন্য ষড়যন্ত্র করছে। কাজেই বজ্রসেন একজন রাষ্ট্রদ্রোহী, ষড়যন্ত্রকারী। তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অথবা মুন্ডু আলাদা করে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হবে। এ ঘোষণা শোনার পর শ্যামার নাওয়া-খাওয়া হারাম হয়ে যায়। তাকে নিয়ে পালিয়ে যাবে সুযোগ নেই। সমস্ত শহরের পয়েন্টে পয়েন্টে তল্লাশি বসানো হয়েছে অপরিচিত বিদেশী ব্যক্তি পাওয়া মাত্রই গ্রেপ্তার করা হবে। নিজের সাথে নিজেই কথা বলছে আর ভাবছে কি করা যায়। ভাবতে ভাবতেই তার কাজের মেয়ে খবর নিয়ে আসলো যে বজ্রসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হবে। যেন গোটা আসমানটাই শ্যামা সুন্দরীর মাথায় এসে আঁচড়ে পড়লো। এখন কি করবে, ভাবতে ভাবতেই বজ্রসেনকে নিয়ে শ্যামার সামনে হাজির হলো সেনাপতি। শ্যামার মুখভঙ্গি দেখে নিশ্চিত হন সেনাপতি, যে এটাই বজ্রসেন। অনেক স্বর্ণমুদ্রা প্রদানসহ যা চাইবে সেনাপতি তাই দিবেন, তবুও শ্যামা বজ্রসেনকে ছেড়ে দিতে বলেন। অপারগতা প্রক্শা করেন সেনাপতি। তবে একটা বিকল্পের কথা বলেন, যার মাধ্যমে বজ্রসেনকে বাঁচানো যাবে। সেটা হলো, আজ রাতের মধ্যেই যদি কেউ বজ্রসেন পরিচয় দিয়ে আত্মবিসর্জন দিতে রাজি হয়, তাহলে বজ্রসেনকে ছেড়ে দেবেন। শ্যামা আরো বিপদে পড়ে যান, কে এমন আছে যে, তার ভালবাসার মানুষকে বাঁচানোর জন্য নিজের জীবন দিতে প্রস্তুত। যদি কেউ থাকে, সে হলো উথ্থিও। ভালবাসার মানুষ শ্যামার মুখ ফসকে বের হওয়া কথা উথ্থিও শুনে ফেলেন। জীবনের শেষবারের মতো কিছু কথা বলে, উথ্থিও রওনা হন শ্যামার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে। শ্যামার কোন বাধাই মানলেন না উথ্থিও। জমিদারের কাছে যখন পরিচয় দিলেন যে, আমিই আসল বজ্রসেন আর ইনি হলেন উথ্থিও। উথ্থিওয়ের পরিচয়ের মধ্যদিয়ে প্রাণে বাঁচলেন বজ্রসেন, অপরদিকে বজ্রসেনের পরিচয় প্রদান করে ফাঁসির কাষ্টে আত্মবিসর্জন দিলেন উথ্থিও। হায়রে ট্রাজেডি!


রাষ্ট্র নামক যন্ত্রটি যে, নীপিড়ক, নির্যাতক ও খুনী তা আবার প্রমাণ হলো রবীন্দ্রনাথের শ্যামা প্রেম নাটক দেখার পর। সামান্য স্বার্থের কারণে শ্যামার শান্তি নষ্ট করলো, বজ্রসেনের মতো নিরাপরাধ একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড জারি করলো। বজ্রসেনকে মেরে ফেল্লে তাও বলতে পারতাম শুধুমাত্র একজন নিরাপরাধ ব্যক্তি বজ্রসেনকে মেরে ফেলা হল! যেটি করা হল, একজন নিরাপরাধ বজ্রসেনকে মুক্তি দেবার জন্য রাষ্ট্রের সেনাপতি হাজার হাজার স্বর্ণমুদ্রা শ্যামার কাছ থেকে হাদিয়া নিল, শ্যামার সুন্দর নারী শরীরকে দুমড়ে মুচড়ে খেলো, অতপর আরেকজন নিরাপরাধ ব্যক্তি উথ্থিওকে বজ্রসেন সাজিয়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করলো এবং বজ্রসেনকে উথ্থিও সাজিয়ে বেকসুর খালাস দেওয়া হলো। রাষ্ট্রের কাছ থেকে এর চেয়ে নিরপেক্ষ বিচার প্রত্যাশা করাটা বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই না। রাষ্ট্র বুঝি এমনই হয়!


সক্রেটিসকে হেমলক খাইয়ে হত্যা করা আর কর্নেল তাহেরকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা অথবা সমসাময়িক রাষ্টেও হত্যাকাণ্ড একই সুত্রে গাঁথা!

গুরু, তোমার কথাই সঠিক, রাষ্ট্র এমনই হয়!

 

live pharmacy
umchltd