ঢাকা সোমবার, ২০ মে ২০২৪ 

অবৈধ এনআইডি চক্রের অপরাধ সাম্রাজ্য

কামাল হোসেন তালুকদার

প্রকাশিত: ২২:৩৮, ৯ মে ২০২৪

আপডেট: ২২:৪০, ৯ মে ২০২৪

শেয়ার

অবৈধ এনআইডি চক্রের অপরাধ সাম্রাজ্য

একজনের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) তুলে নেয় আরেকজন। অবৈধভাবেও তৈরি করা হয় জাল পরিচয়পত্র। তৈরি হচ্ছে ভুয়া জন্মনিবন্ধনও। আর এসব ডকুমেন্ট ব্যবহার করে কেনা হয় মোবাইল সিম। ওই সিম দিয়ে পরিচালনা করা হয় অপরাধ সাম্রাজ্য। আর এভাবে আসল অপরাধী থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। ফেঁসে যান নির্দোষ ব্যক্তি। সম্প্রতি এমন একটি চক্রের সন্ধান পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

 

বুধবার ভয়ঙ্কর ওই চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট (সিটিটিসি)। গ্রেপ্তারকৃতদের বরাতে ওই চক্রের ব্যাপারে দ্য নিউজকে বিস্তারিত জানিয়েছেন, সিটিটিসির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার সাইদ নাসিরুল্লাহ। ‍তিনি বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা টাকার বিনিময়ে অবৈধ উপায়ে জাতীয় পরিচয়পত্রসহ জন্মনিবন্ধন সনদ দিত।

 

তবে চক্রের ‘মূলহোতা’ এখনও অধরা। মুলত ওই ব্যক্তি-ই পাসওয়ার্ড সংগ্রহ করতেন। সিটিটিসি বলছে, যে ব্যক্তির কাছ থেকে তারা পাসওয়ার্ড নিতেন, তিনি একটি বিদেশি নম্বর ব্যবহার করেন। গ্রেপ্তার হওয়া লিটন মোল্লা (২৩) ও জামাল উদ্দিন (৩৮) তাকে কোনোদিন দেখেননি বলে দাবি তাদের।

 

বৃহস্পতিবার দুপুরে সিটিটিসির প্রধান মো. আসদুজ্জামন বলেন, টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সেবা যেমন, হারানো এনআইডির কপি, এনআইডি (NID) সংশোধন, জন্মনিবন্ধনের ডিজিটাল কপি ও নাম সংশোধন, কোভিড-১৯ এর টিকার কপিসহ বিভিন্ন সেবা, টিন (TIN) এর কপি প্রভৃতি অবৈধ উপায়ে  সরবরাহ করতেন।

 

তবে সিটিটিসির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার সাইদ নাসিরুল্লাহ দ্য নিউজকে বলেন, তারা টাকা বিনিময়ে শুধু জাতীয় পরিচয়পত্র-ই দিতেন না। তাদের কাছ থেকে একজনের জাতীয় পরিচয়পত্র আরেকজন তুলে নিতেন। পরিচয়পত্রের প্রকৃত মালিক জানতেন-ই না, তার পরিচয়পত্র আরেকজন তুলে নিয়েছেন।

 

আর ওইসব জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে সিম তুলে জঙ্গিবাসহ নানা অপরাধ করে আসলেও প্রকৃত অপরাধী ধরা পড়তো না।

 

তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিটন মোল্লার অনেকগুলো গ্রুপ রয়েছে। সেই গ্রুপের মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রাহক আসতেন। তাদের চাহিদা মতো জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বরটি জামালকে পাঠাতেন। জামাল কুড়িগ্রাম সদরে নির্বাচন কমিশনের একটি প্রকল্পে ডেটা এন্ট্রি পদে কাজ করতেন।

 

পুলিশ কর্মকর্তা নাসিরুল্লাহ বলেন, নির্বাচন কমিশনের সার্ভার ওপেন করতে আলাদা ওটিপি লাগে। এই ওটিপিও তৃতীয় আরেকজনের কাছ থেকে তারা পেতেন। একবার ওটিপি দিয়ে ওপেন করলে ২৪ ঘণ্টা মেয়াদ থাকে। অর্থাৎ প্রতিদিন সকালে সার্ভার ওপেন করতে হলে ওটিপি লাগে।

 

তৃতীয় ওই ব্যক্তিকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, লিটন বা জামাল কোনোদিন তাকে দেখেননি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচয় হয়েছে। প্রতিদিন একবার ওটিপির জন্য তার দেওয়া মোবাইল নম্বরে তিন হাজার টাকা দিতেন লিটন। না দেখা ওই ব্যক্তি মাসে ৯০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিতেন।

 

তিনি বলেন, তৃতীয় এই ব্যক্তিকে শনাক্তের চেষ্টা চলছে। তিনি একটি বিদেশি নম্বর ব্যবহার করেন।

 

তিনি নির্বাচন কমিশনের কোন প্রকল্পে কাজ করেন জানতে চাইলে সিটিটিসির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার বলেন, মনে হচ্ছে না। তবে কোনোভাবে কারও সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে। তা না হলে ওটিপি নম্বর ওই ব্যক্তি জানবে কিভাবে?

 

আছে অঞ্চল ভিত্তিক চক্র,  রয়েছে শঙ্কা

সাইবার নিয়ে কাজ করা পুলিশের এই কর্মকর্তা দ্য নিউজকে বলেন, জামাল উদ্দিন কুড়িগ্রাম সদরের নির্বাচন কমিশনের একটি প্রকল্পে কাজ করেন। সেখানে থেকেই তিনি একটি চক্র গড়ে তোলেন। সুতরাং সারাদেশে এরকম চক্র যে নেই তা বলা যাবে না।

 

অঞ্চলভিত্তিক এ ধরনের আরও চক্র সক্রিয় জানিয়ে তিনি বলেন, এভাবে যদি যে কেউ নকল জাতীয় পরিচয়পত্র পান, তাহলে অপরাধীদের ধরা মুশকিল। জঙ্গিরা এ ধরনের পরিচয়পত্র দিয়ে সিম তুলে তাদের কার্যক্রম  চালাবে। অবৈধ টাকা লেনদেন হবে।

 

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের হাতে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু না।

এদিকে পুলিশ জানিয়েছে, লিটন মোল্লা ও জামাল উদ্দিন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে টাকার বিনিময়ে অনলাইনে এনআইডি ও অন্যান্য সনদ প্রদানের বিষয়ে স্বীকার করেছেন।

 

লিটন জানান, এনআইডি সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যাবলী নির্বাচন কমিশন প্রকল্পে কর্মরত মো. জামাল উদ্দিনসহ কয়েকজনের মাধ্যমে কমিশনের সার্ভার থেকে পান।

 

প্রতিটি কাজের বিনিময়ে তাদেরকে নির্ধারিত টাকা বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়।

 

লিটন ও জামাল যেসব কাজ করতেন

গ্রেপ্তারকৃত এই দু’জন হারানো এনআইডি’র কপি বা ডুপ্লিকেট কপি, জাল এনআইডি, সিম কার্ডের রেজিস্ট্রেশনের তথ্য ও এর বিপরীতে রক্ষিত এনআইডি প্রদান করতেন।

 

অসম্পূর্ণ কোভিড টিকা কার্ডকে সম্পূর্ণও করে দিতেন তারা। এছাড়া পেছনের কোভিড টিকার তারিখ বসানো, জাল বা ক্লোন কোভিড টিকা কার্ড তৈরি, জন্মনিবন্ধন সনদের ডুপ্লিকেট ডিজিটাল কপি, হারানো বা ডুপ্লিকেট টিন সনদের কপি, জাল এনআইডির মাধ্যমে বিকাশ ও নগদের একাউন্ট করে দিতেন।

 

পুলিশ বলছে, এ কাজগুলোর বিনিময়ে লিটন গ্রাহকের কাছ থেকে ৫০০-২০০০ টাকা পর্যন্ত পেতেন, যার একটা বড় অংশ তার সহযোগীদেরকে প্রদান করতে হতো।

 

তিনি বলেন, হোয়াটসঅ্যাপে গ্রাহকের চাহিদার ভিত্তিতে তিনি তার সহযোগীদের সহযোগিতায় বা নিজের তৈরি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জাল বা ডুপ্লিকেট সরকারি এসব সনদ প্রদান করতেন। বিনিময়ে মোবাইল ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে তারা টাকা পেতেন।

দ্য নিউজ/ কেটি/ আরপি

live pharmacy
umchltd

সম্পর্কিত বিষয়: