ঢাকা সোমবার, ২০ মে ২০২৪ 

কুড়িগ্রামে হারিয়ে যাওয়া পদ্মপুরাণ-ভাসান গানের উৎসব

কুড়িগ্রাম সংবাদদাতা

প্রকাশিত: ১৭:৩৩, ৯ মে ২০২৪

শেয়ার

কুড়িগ্রামে হারিয়ে যাওয়া পদ্মপুরাণ-ভাসান গানের উৎসব

গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী পদ্মপুরাণ (মা মনসামঙ্গল) গানের আসরগুলো দিনদিন কালের বিবর্তনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এক সময় পদ্মপুরাণ ও কুশান গানের ব্যাপক দর্শক প্রিয়তা ছিল দেশের উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামে। গানের সঙ্গে সঙ্গে অসাধরণ নৃত্য ও সংলাপে এসেছে গদ্যছন্দে। মা মনসা ও নাগের জন্ম, দেবতার তুষ্টি, স্বামীভক্তি আর ভালোবাসার কাহিনীই হলো আবহমান বাংলার ভাসান গানের উপজীব্য।

 

কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার বৈদ্যের বাজার এলাকার শ্যামল চন্দ্র রায় বাপ-দাদার প্রাচীন ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে তার নাতির অন্নপ্রাশন উপলক্ষে নিজ বাড়িতে তিনদিন ব্যাপী এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

 

বুধবার রাতে লালমনিরহাট উপজেলার মোস্তাফি এলাকার অতুল চন্দ্র রায় মূল শিল্পীগোষ্ঠীর টিমে মোট ১১ থেকে ১২ জন শিল্পী পদ্মপুরাণ গান ও গীতিনাট্য পরিবেশন করেছেন। এতে প্রাচীন ঐতিহ্য মেনে নারী সেজে পুরুষদের অভিনয়ে দুর-দুরান্তর থেকে আসা আত্মীয়-স্বজনসহ এলাকার শতশত শ্রোতাদর্শক ভাসান গান শুনে মুগ্ধ হয়েছে। এ অনুষ্ঠানের বেহুলা-লখীন্দর ও শিব-পার্বতী কিশোরী মেয়েদের বর-কনে সাজিয়ে বিয়ের অসাধারণ মুহূর্তটা উপস্থিত দর্শকদের মুগ্ধ করে তোলেন। দর্শকরা যেন সত্যি সত্যি শিব পার্বতী ও বেহুলা লখীন্দরের বিয়ে দেখে অভিভুত হন।  

 

জেলার নাগেশ্বরী উপজেলা থেকে আসা ভাসান গানের নারী দর্শক মাধবী রানী রায় ও রাজারহাট বৈদ্যেরবাজার এলাকার মিতালী রানী রায় জানান, আমরা সেই উঠতি বয়সে এ গান শুনেছিলাম। আগে গ্রামে এ গানগুলো বেশ হতো। এখন আর হয় না। ভাসান গানের আয়োজনে মনে হচ্ছে আবারও প্রাণ ফিরে পাচ্ছে প্রাচীন ঐতিহ্য। অনেক বহু বছর পর এখানে দেখে ভালই লাগলো। এই দুই নারী আরও জানান, বিয়ে ও অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠানে গীতের প্রচলন কিন্তু এখনো রয়েছে।

 

ভাসান গান পরিবেশন করা পরিচালক অতুল চন্দ্র রায় জানান, আমরা এই টিমটি এখানে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠান করছি। প্রথম দিন যে পালাটি করেছি সেটি সৃষ্টিপত্তন (জাগানভাসান), দ্বিতীয় দিন শিব পার্বতী ও তৃতীয় দিন বুধবার রাতে বেহুলা লখীন্দর পালাটির মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে।

 

তিনি জানান,  ভাসান মূলত বেহুলা আর লখীন্দরের গীতনাট্য। সাধারণত মাঠের ফসল ওঠার পর রাত জেগে এটি পরিবেশন করা হয়। এলাকাভেদে এই গানের নাম আলাদা আলাদা। আমাদের রংপুর অঞ্চলে বিষহরি ও পদ্মপুরাণ গান নামে পরিচিত। আবার বিভিন্ন অঞ্চলে এ গানের নাম পদ্মপুরাণ গান,পদ্মার নাচন, বেহুলার নাচাড়ি, কান্দনী বিষহরির গান নামে পরিচিত।

 

তিনি আরও জানান, আগের মতো এখন এই অনুষ্ঠানগুলো যেখানে সেখানে হয়। অনেকটা বিলীনের পথে। কিছুটা রক্ষা করছে ধর্ণাঢ্য কিছু হিন্দু পরিবার। আমি পেশার সঙ্গে ৮ থেকে ১০ বছর আছি। কারণ এ অনুষ্ঠানগুলো অনেক ব্যয়বহুল। যার কারণে অনেকে এই অনুষ্ঠানগুলো নিতে চাই না। এখানে আমরা তিনদিন ব্যাপী অনুষ্ঠানের পারিশ্রমিক ১৮ হাজার টাকা নিয়েছে। ১২ জন শিল্পী কাজ করেছি। ৫ দিনের পারিশ্রমিক ৩০ হাজার ও সাত দিনের পারিশ্রমিক ৪০ হাজার টাকা বলে জানান শিল্পী অতুল চন্দ্র রায়। এছাড়াও তিনি গাইবান্ধা, দিনাজপুর ও রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এ অনুষ্ঠান ডাক পান।  

 

শ্যামল চন্দ্র রায় জানান, আমার নাতির অন্নপ্রাশন উপলক্ষে তিনদিন ব্যাপী মা মনসামঙ্গল ও পদ্মপুরাণ গানের আয়োজন করা হয়েছে। আমার বাপ-দাদার আমল থেকে আমাদের বাড়ীতে কারো বিয়ে বা অন্নপ্রাশন হলে এই অনুষ্ঠান চলে আসছে। বাপ-দাদার ঐতিহ্য তুলে ধরতেই নাতির অন্নপ্রাশনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। আমি যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন এ আয়োজন অব্যাহত থাকবে।

 

ফু্লবাড়ী উপজেলার নাওডাঙ্গা স্কুল অ্যান্ড কলেজে অধ্যক্ষ ও কবি সাহিত্যিক আব্দুল হানিফ সরকার জানান, ছোট বেলায় এই গানগুলো শুনতাম। রাত জেগে শুনতাম। কাহিনী ভালই লাগতো। একটা সময় কুশানগান,  পদ্মপুরাণ ভাসান গান গ্রামবাংলা  ঐতিহ্যবাহী গীতিনাট্য হিসাবে পরিচিত ছিল। সারা দেশেই জনপ্রিয় এ গীতিনাট্য মানুষের মনে নির্মল আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি মা মনসা ও নাগের জন্ম ও পূজার প্রচলনের গল্প তুলে ধরতো। সেই সঙ্গে বেহুলার স্বামীভক্তির কাহিনী তুলে ধরা হয়। এখন কালের আর্বতে বিলীনের পথে। গ্রামীণ সংস্কৃতিকে উজ্জীবিত করতে এ ধরনের আয়োজন আরো করা খুবই জুরুরি। তাই এই সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে সবাই এগিয়ে আসা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

দ্য নিউজ/এমএম

live pharmacy
umchltd