ঢাকা সোমবার, ২০ মে ২০২৪ 

অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনে অবদান রাখবে ডিআইএস মিনি গার্মেন্টস

লালমনিরহাট সংবাদদাতা

প্রকাশিত: ১৫:১১, ৯ মে ২০২৪

আপডেট: ১৫:১২, ৯ মে ২০২৪

শেয়ার

অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনে অবদান রাখবে ডিআইএস মিনি গার্মেন্টস

ডোরস ফর ইনক্লুসিভ সোসাইটি বাংলাদেশ (ডিআইএসবিডি) প্রতিবন্ধী এবং সুবিধাবঞ্চিত ব্যক্তিদের জন্য কাজ করে এমন একটি সংগঠন। ওই সংগঠনটির লক্ষ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি হল প্রতিবন্ধী এবং সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের মূলধারার উন্নয়নে অন্তর্ভুক্ত করা। যার ফলশ্রুতিতে তারা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সমান সুযোগ এবং পূর্ণ অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে।

 

২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটি তাদের ওই স্বপ্ন বাস্তবায়নে নানামুখী সহায়তা দেয় ও বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে। তন্মধ্যে রয়েছে প্রতিবন্ধী এবং সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের আবাসন সুবিধা প্রদান, মোটর বাইক বিতরণ, গৃহপালিত পশু বিতরণ, অন্তর্বর্তী স্তরের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কোর্স এবং ল্যাপটপ বিতরণ, অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন প্রশিক্ষণ ও বিতরণ, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের মধ্যে রেডিও সম্প্রচার প্রশিক্ষণ প্রদান, নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে সুইং প্রশিক্ষণ এবং মেশিন প্রদান ইত্যাদি অন্যতম।

 

সুবিধাভোগীদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তারা এ সকল উদ্যোগ নেন। ওই সংগঠনের একজন সদস্য ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী লালমনিরহাটের মুরাদ চৌধুরী ডিআইএস এর প্রেসিডেন্ট ফেরদৌস আলম তমালকে পিছিয়ে পড়া লালমনিরহাট জেলায় জন্য কিছু করার অনুরোধ করেন। তার ওই অনুরোধকে সম্মান জানিয়ে ডিআইএসবিডি লালমনিরহাটে একটি মিনি গার্মেন্টস করেন যার নাম ‘ডিআইএস মিনি গার্মেন্টস’।

 

ডিআইএস এর প্রেসিডেন্ট ফেরদৌস আলম তমাল এখন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হলেও তিনি একসময় চোখে দেখতে পারতেন। একজন স্বাভাবিক মানুষের মতো তিনিও পড়াশুনা করে উচ্চশিক্ষিত হন এবং ভাল চাকুরি করেন। কিন্তু চাকুরিরত অবস্থায় হঠাৎ করে তার চোখে একটি দুরারোগ্য ব্যাধি হওয়ায় তিনি তার দৃষ্টিশক্তি হারান। এরপর তিনি যুক্ত হন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন এনজিওর সাথে। দৃষ্টিশক্তি না থাকলেও সংস্থাটির লক্ষ্য বাস্তবায়নে তার ইচ্ছাশক্তি প্রবল। তিনি দূরদৃষ্টি সম্পন্ন একজন নেতা ও সমাজকর্মী।      

 

লালমনিরহাট জেলা সদরের শহীদ শাহজাহান কলোনীতে অবস্থিত ওই ডিআইএস মিনি গার্মেন্টসের যাত্রা শুরু হয় গত ৩০ এপ্রিল। ওই গার্মেন্টসে প্রাথমিক অবস্থায় পাঁচজন নারী উন্নতমানের ডিজিটাল সেলাই মেশিনে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। সংগঠনটি ও তমালের উদ্দেশ্য হল ওই পিছিয়ে পড়া নারীদেরকে স্বাবলম্বী কর তোলা এবং তাদের সমাজে সম অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়া। ওই গার্মেন্টসের মালিকানায় রয়েছেপ্রতিবন্ধী কিছু মানুষ।

 

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মুরাদ চৌধুরি জানান, মিনি গার্মেন্টসে ৫টা মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। এখানে ৫ জন নারী কাজ করে। আগামীতে হয়তো সুবিধাভোগী নারী ও মেশিনের সংখ্যা বাড়ানো হতে পারে। এখানে যারা উপকৃত হবে তাদের শারীরিক কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। তাদের এখান থেকে কর্মসংস্থান হবে। তারা নিজের পায়ে নিজেরা দাঁড়াবে। এটাই ডিআইএস এর প্রয়াস। ডিআইএস এর মিনি গার্মেন্টসের লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের জন্য কাজ করা।

 

সুবিধাভোগী এক নারী কর্মী জানান, খুব ভাল লাগছে এই ভেবে যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা স্বাভাবিক মানুষদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। এখানে দুঃস্থ মানুষদের নিয়ে কাজ হচ্ছে, মাতৃত্বকালীন সেবা দেয়া হচ্ছে, শীতকালীন বস্ত্র বিতরণ করা হচ্ছে। উনাদের এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। উনাদের সাথে থাকতে পেরে ভাল লাগছে।

 

লালমনিরহাটের সমাজকর্মী ও কবি ফেরদৌসী বেগম বিউটি জানান, তারা প্রশংসার দাবিদার। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের অনেকে সমাজের বোঝা মনে করে। এটা সঠিক নয়। লালমনিরহাটের মুরাদ কিন্তু লেখাপড়া শিখে নিজে শিক্ষিত হয়ে নিজে কিছু করার চেষ্টা করছে। এবং যারা সুস্থ তাদেরকে তারা প্রশিক্ষণ দিবে। 

 

ডিআইএস এর প্রেসিডেন্ট ফেরদৌস আলম তমালের কাছে তার ব্যক্তিজীবন নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার সম্পর্কে যে সমস্ত তথ্য বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রচার করা হয়েছে তার অধিকাংশ ভুলে ভরা। আমাদের ডিআইএস এর অফিসটা মূলত মিরপুর ডিওএইচএস এ অবস্থিত। আমি বনানি ওল্ড ডিওএইচএস এ থাকি। এখানেই দীর্ঘদিন ধরে আমার আবাসস্থল। আমি লেখাপড়া করেছি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে। আমি ইষ্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতেও এমবিএ-তে পড়াশুনা করি। বিভিন্ন মিডিয়াতে বলা হয়েছে যে আমার জন্মসূত্রে দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা আছে বিষয়টি একেবারেই বেঠিক। আমি চাকরিজীবনে থাকা অবস্থায় দৃষ্টিশক্তি হারাই। অপটিক অ্যাট্রোফি নামক একটি রোগের কারণে আমি চিরতরে আমার দৃষ্টিশক্তি হারাই। আমার চোখের নার্ভ শুকিয়ে গেছে যার ফলে আমি দেখতে পাইনা এবং এই রোগের কোন চিকিৎসা এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। যার ফলে আমার দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতার বিষয়টি কিওর করা যায়নি। অনেক দেশে ট্রিটমেন্ট এর জন্য গিয়েও কোন সফলতা মেলেনি। আমার বাবার নাম বদরুল আলম, তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ছিলেন। আমার মায়ের নাম সিলভী আলম। উনি আমেরিকা প্রবাসী এবং একসময় তিনিও অনেক সোশ্যাল ওয়ার্ক করেছেন। আমার স্ত্রী একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন।’

 

মানুষের কল্যাণে কাজ করা কবে ও কীভাবে শুরু করেন এই প্রশ্নের জবাবে তমাল বলেন, ‘এই চ্যারিটি ওয়ার্ক বা উন্নয়ন কর্মী হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত করার বিষয়টির শুরু ২০১৩ সালে আমি যখন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়ে গেলাম তার পরে। তখন আমি ইন্ডিয়া থেকে টকব্যাক বা এনডিডি এগুলো সম্পর্কে জেনে আসি। তারাই আমার মোবাইলে সবকিছু সেট করে দেয়। তখন থেকেই আমি মোবাইলে ইন্টারনেট ব্রাউজিং করতে পারি। তখন আমি দেখতে পারিনা। বাংলাদেশে এসে যখন সার্চ করি তখন আমি বিভিন্ন এনজিওর নাম পাই যেখানে তারা বিভিন্ন রকমের প্রশিক্ষণ দেয়। ওই প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে যেটা হয়েছে যেহেতু আমি মোটামুটি শিক্ষিত, দুটি বিষয়ে মাস্টার্স করার অভিজ্ঞতা আছে ও বিভিন্ন এনজিওতে কাজ করেছি, সেই সুবাদে ওই এনজিওগুলো হয়তো অনুভব করেছে যে, আমাকে দিয়ে কোন কাজ হবে। তখন তারা বিভিন্ন সময় তাদের এক্সিকিউটিভ কমিটিতে আমাকে নিয়ে নেন এবং তাদের সাথে কাজ করবার সুযোগ দেন। তাদের সাথে কাজ করতে গিয়ে যেটা দেখতে পাই আসলে আমাদের যে নিজস্ব প্রবলেমগুলো ওই প্রবলেমগুলো আমরা সমাধান করি না। দেখা যায় কম্পিউটার ট্রেনিং হয় তো শুধু ট্রেনিং দেয়ার উদ্দেশ্যেই হয়। কিন্তু কম্পিউটার এমন একটা জিনিস যা সবসময় ব্যবহার না করলে ওই জ্ঞানটা থাকেনা। আস্তে আস্তে আমরা ভুলে যাই। এছাড়াও প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কমান্ড চেঞ্জ হয়, সফটওয়ারে চেঞ্জ আসে। আমার তখন মনে হয় যে, এটা প্রসেস হতে পারে না। আমাকে যদি একটা স্টুডেন্টকে সত্যিকারে কম্পিউটার শিখাতে হয় আগে তার হাতে একটা ল্যাপটপ দিয়ে দিতে হবে। তারপর সে তার ল্যাপটপে শিখবে, তার চর্চা হবে। সে ভালোভাবে জ্ঞানার্জন করতে পারবে। পরবর্তী পর্যায়ে সে তার ল্যাপটপ দিয়ে আউটসোর্সিং এর মতো কাজ করে আয় করতে পারবে। ওই প্রেক্ষাপট ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আমরা ল্যাপটপ বিতরণ ও কম্পিউটার ট্রেনিং কোর্স শুরু করি।’

 

লালমনিরহাটে কেন ও কীভাবে মিনি গার্মেন্টস করার উদ্যোগ নিলেন এই প্রশ্নের উত্তরে তমাল বলেন, ‘কার্যক্রম চলাকালে যেটা হয় যে বিভিন্ন এলাকার মানুষজনদের নিয়ে একটা হোয়াটাসঅ্যাপ গ্রুপ গড়ে ওঠে। ওই গ্রুপগুলোতে বিভিন্ন জায়গার ছেলেমেয়েরা যুক্ত হয়। আমাদের বাংলাদেশের ডিআইএস এর বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন শাখা আছে। যেমন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা এছাড়াও ঢাকা কলেজে শাখা আছে। অপরদিকে রংপুরে ও রাজশাহীতে কমিটি আছে এবং বেশ কিছু জায়গায় আমরা কমিটি তৈরি করে নিয়েছি বা শাখা আছে। সেই সুবাদেই আমার মুরাদ চৌধুরির সাথে পরিচয়। সে আমাদের লালমনিরহাটের শাখার একজন সদস্য। তারা যখন আমাদেরকে উত্তরবঙ্গে কিছু করার জন্য অনুরোধ করে তখন আমরা রংপুরে দুঃস্থ মানুষদের মাঝে কম্বল বিতরণ করি। তখন মুরাদ তাদের ওখানে কিছু করতে বলে। সেজন্যই লালমনিরহাটে আমরা এই মিনি গার্মেন্টস শুরু করি। আমাদের উদ্দেশ্য হল প্রতিবন্ধী মানুষ ও সমাজে পিছিয়ে পড়া দরিদ্র মানুষ যারা আছেন তাদেরকে একত্রিত করে যদি একটা সেলফহেল্প গ্রুপ করা যায় সেটা করা। এর ফলে তারা নিজেরাই নিজেদের সমস্যার সমাধান করে ইনকাম করবে। তাদের এটা করতে যা প্রয়োজন সেই জিনিসটা আমরা তাদেরকে দিয়ে দিই। এই কাজটা করলাম। এখন দেখা যাক কি হয়। যদি তারা ভাল করতে পারে ভাল। আর খারাপ করলে দুঃখ পাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নাই।’

 

লালমনিরহাটে ভবিষ্যতে কিছু করার পরিকল্পনা আছে কিনা এ বিষয়ে জানতে চাইলে তমাল বলেন, ‘ডিআইএসতো অনেক ধরনের কাজই করে থাকে। আপনাদের উত্তরবঙ্গে করবার মতো অনেক কাজই আছে। আপনাদের ওখানে জমির অভাব আছে। এছাড়াও আরও নানাবিধ সমস্যা আছে। আরও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যেতে পারে। আমের প্রসেস নিয়ে ব্যবসায়িক উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে যেমন আমের আঁচারের একটা কারখানা করা যেতে পারে। আমরা আরও নানা রকমের আয়োজন করতেই পারি। এখন আপাতত লালমনিরহাট নিয়ে কোন পরিকল্পনা নেই তবে হয়তো ভবিষ্যতে করা হলেও হতে পারে’। 

দ্য নিউজ/এমএম

live pharmacy
umchltd