সড়ক দুর্ঘটনায় চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে টানা তৃতীয় দিনের মতো সড়ক অবরোধ করেছে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা। এর ফলে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন রাউজান, রাঙ্গুনিয়া ও কাপ্তাইসহ এ সড়ক দিয়ে চলাচলকারী লাখো মানুষ। ওই সড়ক দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী থেকে শুরু করে সকল প্রকারের জিনিসপত্র আনা-নেয়া বন্ধ রয়েছে। এরমধ্যে ঘাতক বাস চালককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
বুধবার ( ২৪ এপ্রিল) দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালী এলাকা থেকে জেলা পুলিশের একটি বিশেষ টিম বাস চালক তাজুল ইসলামকে (৪৯) গ্রেপ্তার করে। তিনি চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের করম আলী হাজির বাড়ির আবদুল খলিলের পুত্র। আটকের পর তাকে আদালতের সোপর্দ করা হয়েছে।
এরআগে সোমবার (২২ এপ্রিল) বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে চট্টগ্রাম কাপ্তাই সড়কের সেলিনা কাদের চৌধুরী কলেজ সংলগ্ন এলাকায় বাসের সাথে মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে চুয়েটের দুই শিক্ষার্থী শান্ত সাহা ও তৌফিক হোসেন নিহত হয়। এই ঘটনায় আরও একজন শিক্ষার্থী আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। নিহত শান্ত সাহা পুরকৌশল বিভাগের ’২০ ব্যাচের শিক্ষার্থী (আইডি-২০০১১০০)। তিনি নরসিংদীর কাজল সাহার পুত্র। আর তৌফিক হোসেন একই বিভাগের ২১ ব্যাচের শিক্ষার্থী (আইডি-২১০১০০৬)। তিনি নোয়াখালী সুধারামের নিউ কলেজ রোডের মোহাম্মদ দেলোয়ারের পুত্র।
এদিকে, খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বুধবার সকাল ৯টার দিকে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে (চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কে) বসে পড়েন শিক্ষার্থীরা। যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের দশ দফা দাবি মেনে নেওয়া না হবে ততক্ষণ এ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা।
এর আগে মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) সকাল ৯টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এ সড়ক পথ অবরোধ করে রাখেন শিক্ষার্থীরা। রাত ১০টায় শিক্ষার্থীরা হলে ফিরে গেলে হাতেগোনা কয়েকটি যানবাহন চলাচল করতে দেখা যায়। সড়ক দুর্ঘটনায় দুই সহপাঠীকে হারিয়ে নিরাপদ সড়কসহ ১০ দফা দাবিতে আন্দোলনে নামেন চুয়েট শিক্ষার্থীরা। যাত্রীবাহী একটি বাসে অগ্নিসংযোগ আরও দুটি বাস ভাঙচুর চালায় তারা।
জানা যায়, বিভিন্ন দাবি দাওয়া মেনে নেওয়ার বিষয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রশাসন মতবিনিময় করলেও হয়নি এর সুরাহা। আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে সড়ক অবরোধ করে রেখেছে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এতে জরুরি ওষুধ সরবরাহকৃত পরিবহন, পণ্যবাহী পরিবহন এবং যাত্রীবাহী পরিবহন চলাচল সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন লাখে মানুষ।
চুয়েট সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় ১০ দফা দাবি উত্থাপন করে ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয় শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক এদিন দুপুরের পর চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে সকল পক্ষকে নিয়ে বৈঠকে বসে ক্ষতিপূরণ প্রদানসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বৈঠক শেষে রাতে ক্যাম্পাসে ফিরেন চুয়েট ভিসি। রাত ৯টায় সে সিদ্ধান্তসমূহ উত্থাপন করেন চুয়েট ভিসি ড. রফিকুল আলম। এসময় সহ চুয়েটের শিক্ষকবৃন্দ, রাউজান ও রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। তবে চুয়েট ভিসির ১০ দফা দাবি মেনে নেওয়ার বিষয়টি হাস্যকর বলে ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দিয়ে চুয়েট শহীদ মিনারস্থল ত্যাগ করেন শিক্ষার্থীরা। ব্যর্থতা নিয়ে ফিরে যান চুয়েট ভিসি।
এসময় রাত ১০ টায় অবরোধ স্থগিত করে বুধবার সকাল ৯টা থেকে পুনরায় সড়ক অবরোধসহ প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
এদিকে চুয়েটের দুই শিক্ষার্থী শান্ত সাহা ও তৌফিক হোসেন নিহতের ঘটনায় চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট একেএম গোলাম মোর্শেদ খানকে প্রধান করে সাত সদস্যদের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। সদস্য করা হয় চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার একজন প্রতিনিধি, রাউজান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অংগ্যজাই মারমা, রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রায়হান মেহেবুব, বিআরটিসির সহকারী পরিচালক রায়হানা আক্তার উর্থি, রাঙ্গুনিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) চন্দন কুমার চক্রবর্তী ও রাউজান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহেদ হোসেন।
এই প্রসঙ্গে চুয়েট ভিসি ড. রফিকুল আলম বলেন, শিক্ষার্থীদের ১০ দফা দাবির প্রথম দফা ছিল পলাতক আসামি ও খুনি ড্রাইভার, তার সহযোগীদের খুবই দ্রুত গ্রেপ্তার এবং এদের মালিক শাহ আমানত বাস কর্তৃপক্ষের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ভুক্তভোগীদের পরিবারকে যথার্থ ক্ষতিপূরণ দিতে ও আহত শিক্ষার্থীর চিকিৎসার সকল দায়িত্ব নিতে বাধ্য থাকবে শাহ আমানত বাস কর্তৃপক্ষ এবং এ ব্যাপারে চুয়েট কর্তৃপক্ষকে বাদী হয়ে মামলা করতে হবে।
তিনি বলেন, বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চালক গ্রেপ্তার হয়েছে। তার শাস্তির বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়া। চুয়েট কর্তৃপক্ষ চালকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে ৫লাখ করে দুই নিহত পরিবারকে ১০ লাখ টাকা, আহত পরিবারকে ৩ লাখ টাকা, বাস মালিক সমিতির পক্ষ থেকে দুই নিহত পরিবারকে দুই লাখ করে ৪ লাখ টাকা, আহত পরিবারকে ১লাখ টাকা প্রদান করা হবে। কিন্তু এ ক্ষতিপূরণ মেনে নেয়নি শিক্ষার্থীরা।
চুয়েট ভিসি বলেন, শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় দফা দাবি ছিল চট্টগ্রাম-কাপ্তাই মহাসড়কের দ্রুত প্রশস্থকরণ কার্যক্রম শুরু এবং এই রুটে দুরপাল্লার বাস ব্যতীত সকল লোকাল বাস (এবি ট্রাভেলস, শাহ আমানত ও অন্যান্য) চলাচল নিষিদ্ধ করতে হবে। দুটি বিষয়ে প্রশাসন আশ্বাস দিলেও শিক্ষার্থীরা মেনে নেয়নি।
দ্য নিউজ/ আর পি
আরও পড়ুন: