মাত্রাতিরক্ত মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটারে চোখ রাখতে রাখতে আমরা যে কতটা চোখের মারাত্মক অসুখের দিকে ধাবিত হচ্ছি, তা জানলেও মানতে চাই না । গুরুতর ভাবে প্রভাব ফেলছে মস্তিষ্কেও। যেমন ড্রাই আইজ, চোখ লাল হয়ে যাওয়া, জ্বালা করা কিংবা অনবরত চোখ থেকে জল পড়া । এসব লক্ষণ দেখলে মোটামুটি সতর্ক হই এবং বিশেষজ্ঞের স্মরণাপন্ন হই । যদি এমন হয়, কোন লক্ষণ ছাড়াই চোখের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যায়, তাহলে? হ্যা, এমনই একটি নিরব ঘাতক হচ্ছে গ্লকোমা। চিকিৎসকেরা বলছেন, সঠিক সময়ে এই রোগ ধরা না পড়লে দৃষ্টিশক্তি একেবারে নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
বিশ্বের প্রায় ৭ কোটি লোক গ্লকোমায় আক্রান্ত। বাংলাদেশে পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব ব্যক্তিদের শতকরা প্রায় তিনজনের গ্লকোমা রয়েছে। কিন্তু আমরা তা নিয়ে খুব একটা সচেতন না । তবে সঠিক সময়ে চিকিৎসা করলে সুস্থ হওয়া সম্ভব।
গ্লকোমা কি ?
গ্লকোমায় আক্রান্ত হলে একেবারে শুরুর দিকে রোগীর ‘সাইড ভিশন’ অর্থাৎ পাশের জিনিস দেখার ক্ষমতা নষ্ট হতে থাকে। কিন্তু এই গ্লকোমাটি কি ? রক্তের যেমন চাপ বা প্রেসার আছে, তেমনি চোখেরও একটি নির্দিষ্ট চাপ রয়েছে। চোখের স্বাভাবিক চাপ ১০-২০ মিমি মারকারি। চোখের যে অংশে তরল প্রবাহিত হয় তা যদি কোন কারণে ব্যাঘাত ঘটে, তাহলে অন্য কোন এক জায়গায় তা ধীরে ধীরে জমাট বাঁধতে শুরু করে। এই কারণে চাপ বেড়ে অপটিক নার্ভের ক্ষতি হয় এবং ধীরে ধীরে নার্ভটি শুকিয়ে যায়। যাকে ‘ইন্ট্রাঅকুলার প্রেশার’ বলা হয় । যার কারণে চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হতে শুরু করে এবং একটা সময় তা অন্ধত্বে রূপ নেয়। এ অবস্থাকেই বলা হয় গ্লুকোমা। এই রোগের মারাত্মক দিক হচ্ছে এটি কোনরকম উপসর্গবিহীন। তাই এটিকে নিরব ঘাতক বলা হয়। মোট কথা চোখের প্রেসার (চাপ) বৃদ্ধিজনিত কারণকে গ্লুকোমা বলে। শরীরে প্রেসার বৃদ্ধি হলে তাকে যেমন বলি হাইপার টেনশন, তেমনি চোখের প্রেসার বৃদ্ধিকে আমরা বলি গ্লুকোমা।
কেন গ্লুকোমা সম্পর্কে জানা জরুরী ?
বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী অন্ধত্বের দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে চোখের গ্লুকোমা । এই রোগে দৃষ্টির পরিসীমা ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসে এবং কেন্দ্রীয় দৃষ্টিশক্তি অনেক দিন ঠিক থাকে। তাই রোগী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে অনেক দেরি করে ফেলেন। যার ফলে ব্যক্তি যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা বোঝার আগেই চোখের স্নায়ু অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এটি এমন একটি অনিরাময়যোগ্য রোগ যে দৃষ্টি একটু ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা আর ঠিক করা যায় না। তাই সময় থাকতে এর চিকিৎসা না করলে নিবর এই ঘাতক রোগীকে খুব দ্রুত চিরস্থায়ী অন্ধত্বের দিকে নিয়ে যায়।
গ্লকোমার অনেক ধরন রয়েছে। যেমন—প্রাথমিক অ্যাংগেল খোলা গ্লুকোমা, প্রাথমিক অ্যাংগেল বন্ধ গ্লুকোমা, সেকেন্ডারি গ্লুকোমা, জন্মগত গ্লুকোমা ইত্যাদি।
১. প্রাথমিক অ্যাংগেল খোলা গ্লুকোমা
এ ধরনের গ্লুকোমা হল সবচেয়ে সাধারণ ধরনের গ্লুকোমা। তবে এটি দীর্ঘস্থায়ী, প্রগতিশীল এবং অপরিবর্তনীয়। এটি এতটাই উপসর্গবিহীন এবং ধীরে ধীরে মারাত্মকের দিকে ধাবিত হয়। কখন রোগীর দৃষ্টি শক্তি গ্রাস করে তা বোঝাই যায় না। যাদের উচ্চমাত্রার ইন্ট্রাওকুলার চাপ, অগ্রসর বয়স, পারিবরিক ইতিহাস, বিশেষ করে আফ্রিকানদের মধ্যে এই সমস্যাটা বেশী দেখা যায়। নিয়ন্ত্রণহীন ডায়াবেটিস এবং উচ্চরক্তচাপের জন্যও রোগীরা এর শিকার হয়ে থাকেন।
লক্ষণ: ফোলা কর্নিয়া, পেরিফেরাল দৃষ্টি হ্রাস, চোখের লালভাব, বমি বমি ভাব পিউপিল প্রসারণ যা আলোর উজ্জ্বলতার সাথে পরিবর্তিত হয় না।
২. প্রাথমিক অ্যাংগেল বন্ধ গ্লুকোমা
যখন চোখের ভিতরে চাপ স্বাভাবিকের থেকে অনেক বেশি হয়ে যায়, তখন চোখের তরলটি নিজের গতিতে প্রবাহিত না হতে পেরে চোখের অগ্রভাগ দিয়ে প্রবাহিত হয়। এই অবস্থাই বন্ধ গ্লুকোমা । এধরনের গ্লুকোমা তীব্র এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে । এগুলোর লক্ষণ চিহ্নিত করা বেশ কঠিন। এতে শিকার হয় মূলত যারা ৬০-৭০ বছর বয়সের মধ্যে রয়েছেন এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন তারা ।
লক্ষণ: চোখের লাল ভাব, চোখে তীব্র ব্যথা অনূভব হওয়া, ঝাপসা দৃষ্টি, বমির অনেক প্রবণতা ও বস্তুর চারপাশে সাদা হ্যালোর দৃশ্যমানতা।
৩. সেকেন্ডারি গ্লুকোমা
সেকেন্ডারি গ্লুকোমা হল প্রগতিশীল অপটিক নার্ভ ডিজঅর্ডারের একটি সংগ্রহ যা ইন্ট্রাকুলার প্রেশার (IOP) বৃদ্ধির সাথে যুক্ত। যার ফলে দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে যায়। ক্লিনিকাল সেটিংসে, এটিকে 21 mmHg-এর উপরে IOP-এর ঘটনা হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় । এটি প্রাথমিক গ্লুকোমার মত এক বা উভয় চোখকেই প্রভাবিত ও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। কুইগলির জরিপে জানা যায় বিশ্বের প্রায় ৬ মিলিয়ন মানুষ সেকেন্ডারি গ্লুকোমার শিকার । এটি দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতার অন্যতম কারণ। তবে এটি অনেক সময় দীর্ঘমেয়াদি কোন চিকিৎসা ছাড়াই অস্থায়ী ও শান্ত হয় । এটি মূলত স্টেরয়েডের ব্যবহার, চোখের আঘাত, প্রদাহ, ডায়াবেটিসের কারণে বেশি দেখা দেয়।
লক্ষণ: পেরিফেরাল দৃষ্টিতে দাগের উপস্থিতি, চোখ ব্যথা, আলোর চারপাশে দৃশ্যমান হ্যালোস ও চোখ লাল হয়ে যাওয়া। এই লক্ষণ গুলো অনূভূত হওয়ার সাথে সাথে দেরি না করে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
৪. জন্মগত গ্লুকোমা
এধরনের গ্লুকোমা বিরল । যা শিশুদের মধ্যে বেশি হয়। অনেকেই মনে করেন বয়স বেশি হলেই হয়তো এ রোগের শিকার হতে হয় । কিন্তু শিশুরাও এর অন্তভূক্ত ।
মায়ের গর্ভকালীন শিশুর চোখের যে বৃদ্ধি হওয়ার কথা, যদি কোনো কারণে সেই বৃদ্ধি না হয়, কোনো কারণে চোখের পানির যদি পরিবহন না হয় অর্থাৎ পানি যদি বেরিয়ে না যেতে পারে, সেটি জমা থাকলেই প্রেসার বৃদ্ধি পাবে। আর ছোটবেলায় যেহেতু সবকিছু থাকে নরম, তখন এটি বড় হয়ে যায়। আর বড় হতে থাকলে তার দৃষ্টিতে তো বিষয়টি অবশ্যই প্রভাব ফেলবে।
লক্ষণ: বাচ্চার চোখ দিয়ে পানি পড়ে, আলোর দিকে তাকাতে পারে না, চোখের মণি ঘোলা হয়ে যায়, সময়ের সাথে চোখের মণিটা বড় হয়ে যাওয়া।
চোখের যখন প্রেসার বাড়ে, চোখের যে নালিটা মস্তিষ্কের সঙ্গে সংযুক্ত, সেই নালিতে চাপ পড়ে, সেটিও তখন নষ্ট হয়ে যায়। নষ্ট হলে স্থায়ীভাবে অন্ধত্বের দিকে চলে যায়। যখনই কোনো শিশুর চোখ দিয়ে পানি পড়বে, কালো মণি ঘোলা হবে- তখন ধারণা করতে হবে, তার চোখের প্রেসার বৃদ্ধি পেতে পারে। তখন দেরি না করে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।
কি কি কারণে গ্লকোমা হতে পারে?
১. চোখের উচ্চচাপকেই গ্লুকোমার প্রধান কারণ বলে ধরে নেওয়া হয় ।
২. অল্প আলোতে অনেকক্ষণ পড়াশুনা, সেলাই, মোবাইল বা ল্যাপটপে কাজ করলে চোখের উপর চাপ পড়ে তা গ্লুকোমার সৃষ্টি হতে পারে । ক্ষীণ আলোতে বা অন্ধকারে কাজ করলে যদি কারও চোখ ও মাথায় যন্ত্রণা করে তবে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে ভূলবেন না।
৩. জেনেটিক কারণ
৪. জন্মগত ত্রুটি
৫. চোখে আঘাত বা নির্দিষ্ট ধরনের কোন সার্জারির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
৬. চোখের তীব্র সংক্রমণ
৭. চোখের ভিতর রক্তনালী দ্বারা ব্লকেজ ।
মিলিয়ে দেখুন গ্লুকোমায় সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা তালিকায় আপনি নেই তো !
১. আপনার বয়স কি ৬০ বছরের বেশি ?
২. উচ্চ অভ্যন্তরীণ চোখের চাপ আছে?
৩.পরিবারের একজন সদস্যের গ্লুকোমা ধরা পড়েছে ?
৪.ডায়াবেটিস, হার্টের অবস্থা, সিকেল সেল অ্যানিমিয়া এবং উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগে কি আক্রান্ত ?
৫.পাতলা কর্নিয়া আছে ?
৬.নিকটদৃষ্টি বা দূরদৃষ্টির চরম সমস্যা রয়েছে ?
৭.চোখে আঘাত, অস্ত্রোপচার হয়েছে ?
৮.দীর্ঘদিন কর্টিকোস্টেরয়েড ওষুধ সেবন করেন ?
যদি উপরোক্ত সমস্যায় থাকেন তাহলে আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করেই জরুরী ভিত্তিতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।
গ্লুকোমা রোগ নির্ণয়
১. টোনোমেট্রি
ইন্ট্রাওকুলার প্রেসার বা আপনার চোখে চাপ পরিমাপ করার জন্য ডাক্তাররা এই পরীক্ষা করেন।
২. প্যাকাইমেট্রি
চক্ষু বিশেষজ্ঞরা কর্নিয়ার পুরুত্ব পরিমাপের জন্য এই চক্ষু পরীক্ষাটি করেন।
৩. গনিওস্কোপি
এটি নিষ্কাশন কোণ পরীক্ষা করার জন্য একটি ব্যথাহীন চোখ পরীক্ষা ।
৪. ভিজ্যুয়াল ফিল্ড টেস্ট (পেরিমিট্রি)
চাক্ষুর ক্ষেত্রের ক্ষতি শনাক্ত করতে এই পরীক্ষা করা হয়।
৫. প্রসারিত চোখের পরীক্ষা
এটি আপনার চোখের পিছনে আপনার অপটিক স্নায়ুর ক্ষতি শনাক্ত করার জন্য সম্পাদিত অগ্রণী পদক্ষেপ।
এই রোগের চিকিৎসা
গ্লুকোমা রোগটি নিয়ন্ত্রত করা যায়। কিন্তু সম্পূর্নরূপে তা র্নিমূল করা যায় না। ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, ক্যান্সারের মত এই রোগটিও আমৃত্যু কাঁধে নিয়ে বেড়াতে হয়। এর দ্বারা দৃষ্টির যে ক্ষতিসাধন হয়েছে তা আর ফিরিয়ে না আনা গেলেও দৃষ্টি যেন আর না কমে তাই চিকিৎসার মধ্যে থাকতে হবে। যেহেতু রোগটির প্রধান কারণ চোখের উচ্চচাপের জন্য। তাই ঔষধ দ্বারা এবং ৩ মাস অন্তর অন্তর চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
তিনভাবে এই রোগের চিকিৎসা করা যায়
১. লেজার চিকিৎসা
২. ঔষধ
৩. সার্জারী
প্রতিরোধ
এই রোগের প্রতিকার না থাকলেও প্রতিরোধ আছে । নিয়মিত চোখ পরীক্ষা করতে হবে । নিয়মিত চোখের ব্যায়াম করতে পারেন। খেলাধূলা বা যেকোন ঝামেলার স্থানে নিজের চোখকে আঘাত থেকে এড়ি[য়ে রাখুন এবং সর্বদা সচেতন থাকুন ।
দ্য নিউজ/ এজে/ এএস